ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

নিরাপদ মাতৃত্ব এগিয়ে নিচ্ছে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ   

প্রকাশিত : ২১:১৫, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বিশাল এই জনসংখ্যার দেশে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যই সম্পদ বলে একটি প্রবাদের কথা আমরা জানি, এই স্বাস্থ্য যেমন ব্যক্তির সম্পদ তেমনি সুস্বাস্থ্য দেশেরও সম্পদ। স্বাস্থ্যবান একটি জাতি গড়ে তুলতে পারলে দেশ অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারে। সামগ্রিকভাবে জাতির সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে অবশ্য অনেক বিষয় দেখভালের ব্যাপার আছে, একটি বিষয় আরেকটি বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এখানে। আমরা এখন দৈনন্দিন জীবনে যে ব্যয় করি, তার সিংহভাগই চলে যাচ্ছে ডাক্তারি পরামর্শ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধের পেছনে। 

চিকিৎসা সেবার পেছনে এত বড় খরচের হার আবার শহরে বেশি, বিশেষত ঢাকা শহরে। গ্রামের মানুষের চিকিৎসা ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম সেটি সেবার অপ্রতুলতা হোক বা ডাক্তারের কাছে না যাওয়ার প্রবণতা বা অভ্যাস থেকেই হোক। অন্যদিকে গ্রাম পর্যায়ে এখনো চিকিৎসার বানিজ্যিকীকরণ মহামারি আকার নেয়নি। যাইহোক, শহরে মধ্যবিত্তদের জীবনে এখন ভয়ানক সব অসুখ-বিসুখ দাঁনা বাঁধার পেছনেও শহুরে দূষিত আবহাওয়া ও ভেজাল ও বিষযুক্ত খাবারসহ নানাবিধ কারণ চিহ্নিত করার সুযোগ আছে। স্বাস্থবিশেষজ্ঞরা বিষয়টি ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।

একটি বিষয় খুব পরিস্কার যে, জাতিকে সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যবান করে গড়ে তুলতে হলে শুরুতে আমাদের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের দিকে গুরুত্বারোপ করতে হবে। জাতীয় উন্নয়নে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষা অপরিহার্য বিষয়, গর্ভবতী মা ও নবজাতকের মানসম্মত পরিচর্যা এবং রোগ প্রতিরোধ করা না গেলে দেশকে তথা ভবিষ্যত সুরক্ষা দেওয়া কঠিন। সম্প্রতি ‘নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’ চলে গেল, আমরা হয়তো কেউ কেউ খবরই রাখিনি।

সরকারি সংস্থাসমূহের গেল কয়েকবছরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। বিশেষত মা ও শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারের কনসার্ন করেছে। এজন্য প্রতি ৬ হাজার জনগণের জন্য ১টি করে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এবারের ‘নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’ এর প্রতিপাদ্য ছিল ‘কমাতে হলে মাতৃমৃত্যু হার, মিডওয়াইফ পাশে থাকা একান্ত দরকার’। অথচ আমাদের অনেকের কাছেই আধুনিক এই মিডওয়াইফ সেবার কথা পৌছেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত এবং মাতৃমৃত্যু হ্রাসে মিডওয়াইফ সেবা বিস্তৃত করেছে। এজন্য মিডওয়াইফারি শিক্ষা ও সার্ভিসকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে সরকার। মা ও শিশুর মানসম্মত সেবাদানে ইউনিয়ন সাব-সেন্টার ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যারা প্রসবের সময় দক্ষ হাতে ভূমিকা রাখতে পারে।
উন্নতমানের মাতৃ ও নবজাতকের সেবা প্রদানের জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ, উন্নতমানের সেবা, জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের অঙ্গীকার। এ লক্ষ্যে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের অধীনে মিডওয়াইফারি কোর্সসহ ওয়েব বেইজড মাস্টার্স ও পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করেছে সরকার। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নার্সিং ইনস্টিটিউট ও নার্সিং কলেজের ভেতরেও এ সংক্রান্ত পড়াশোনার দরজা খোলা রাখা হয়েছে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় শিশু মৃত্যুহার কমিয়ে আনার কথা রয়েছে। অর্থাৎ আমরা যদি দেশের টেকসই উন্নয়ন চাই তবে মাতৃ ওশিশুস্বাস্থ্যের উন্নতির বিকল্প নেই। এখন প্রশ্ন হলো, এই বিশাল জনসংখ্যার দেশে শুধু সরকারি পর্যায়ের উদ্যোগ দিয়ে নিরাপদ মাতৃত্ব ও প্রসব নিশ্চিত করা সম্ভব কিনা সেটি প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয়। প্রসবের সময় যেমন অনেক মায়ের মৃত্যু হয়, তেমনি প্রসবপরবর্তী অনেক মৃত্যু ঘটে অনেক নবজাতকেরও। অশিক্ষা ও অসচেতনতার কারণে মৃত্যু ঘটে থাকে বলে ধরে নেওয়া হয়। নিরাপদ মাতৃত্ব প্রতিটি মায়ের অধিকার। এই অধিকারকে প্রতিটি নারীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১২ থেকে ১৫ হাজার প্রসূতির মৃত্যু হচ্ছে মা হওয়ার আগেই।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতা, গর্ভকালীন প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়া ও অদক্ষ ‘দাই’য়ের হাতে বাচ্চা প্রসব করানোর ফলে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার খুব বেশি। বর্তমানে শতকরা ১৫ ভাগ প্রসব বিভিন্ন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে হয়ে থাকে। বাকি ৮৫ ভাগ প্রসব বাড়িতে অদক্ষ ‘দাই’ অথবা নিকট আত্মীয়দের দ্বারা হয়। ফলে অনেক সময় গর্ভকালীন বা গর্ভপরবর্তী জটিলতায় অনেক মায়ের অকালমৃত্যু ঘটে থাতে।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) বরাত দিয়ে গণমাধ্যম জানায়, বাংলাদেশের ১৫-২৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠী হচ্ছে বৃহত্তম প্রজননক্ষম অংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে এ অংশের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। এ বয়সী জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন কারণে প্রজননস্বাস্থ্যের সমস্যা হয়। জরিপে দেখা গেছে, শিশু জন্ম দেয়ার সময় প্রতি লাখে ৩২০ জন মায়ের মৃত্যু হয়। এদের বেশির ভাগেরই বয়স ১২ থেকে ১৯-এর মধ্যে। আর এই মৃত্যুর মূল কারণ প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা। বাংলাদেশের মাত্র ১৩ শতাংশ নারী প্রসবকালে দক্ষ ধাত্রীর সেবা পান। প্রাক-প্রসবকালীন স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য গর্ভবতী নারীকে এখনও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হাসপাতালে নেয়া হয় না। গর্ভবতী নারীদের ১৪ শতাংশ গর্ভাবস্থায় স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন, যা তাদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ।

বাংলাদেশে প্রতিবছর ১২ থেকে ১৫ হাজার প্রসূতির মৃত্যু হচ্ছে। মাতৃত্বকালে উপযুক্ত পুষ্টি ও শক্তির চাহিদা পূরণ না করলে, একদিকে যেমন নারীর স্বাস্থ্য ভাঙ্গতে শুরু করে, অন্যদিকে দেহের ভ্রুণ বা শিশুর ওপরেও তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। ঠিক তেমনি এই অপুষ্টি শেষপর্যন্ত অনিরাপদ মাতৃত্বর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। ভ্রুণ অবস্থাতেই যদি মায়ের স্বাস্থ্য অবনতির দিকে যেতে থাকে তাহলে জন্মের পরে শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই শিশুর জন্মদান এবং তার পরবর্তী প্রক্রিয়াসমূহের দিকে নজর রাখা সকলের কর্তব্য। মাতৃমৃত্যু হার কমিয়ে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকরণ ও শিশুস্বাস্থের উন্নতিকল্পে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প চালু রেখেছে।

১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে ৫০ শতাংশ। গর্ভধারণসংখ্যা কমলে প্রসবঝুঁকিও কমে। বাংলাদেশে ৪ শতাংশ মায়েদের মৃত্যু হার কমেছে গর্ভধারণের বয়স বাড়ার জন্য। কম বয়সে গর্ভধারণ করলে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। সরকারি, বেসরকারি এবং এজিও একসঙ্গে কাজ করার ফলে যেহেতু ধনী-দরিদ্রের স্বাস্থ্যসেবার বৈষম্য দিনে দিনে কমে আসছে আমরা আশা করতে পারি আগামি দিনে শতভাগ নিরাপদ মাতৃত্ব জাতিকে উ্পহার দেবে সরকার। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত হলে শিশুস্বাস্থ্যেরও ঝুঁকি কমবে। গড়ে উঠবে নিরাপদ ও সুস্বাস্থবান বাংলাদেশ।

লেখক# ভাইস প্রেসিডেন্ট, এফবিসিসিআই।

এসি

  


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি